মূল্যবোধের অভাব, সমাজের অপ-সংস্কৃতি, অপরাজনীতিই বর্তমানে মূল মন্ত্র
মু. খালিদ হোসেন মিল্টন: মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ অপরাধী যেই হোক তার কোন দল নেই, পরিচয় নেই। একটাই পরিচয় সে অপরাধী। ধর্ষণকারী, জঙ্গী, খুনী, মাদক ও রাষ্ট্রীয় ক্ষতি সাধিত হয় এমন কেউ ছাড় পাবে না, সে যত বড় ক্ষমতাবান মন্ত্রী, এমপি, জনপ্রতিনিধি, বিত্তশীল, দলবাজ কাউকেই তিনি ছাড় দেয়নি এবং ভবিষ্যতেও তিনি ছাড় দেবেন না।
প্রধানমন্ত্রীর এই সিদ্ধান্ত দেশের বিত্তশীল ও দেশপ্রেমিক মানুষকে কতটা প্রশান্তি দিয়েছে তা বোঝা সকলের জন্য সম্ভব হবে নয়। বর্তমান কোভিড-১৯ বিশ্বব্যাপি যে অস্থিরতা, প্রাণহানী, অর্থনৈতিক দূরাবস্থা এবং শত শত মানুষের কর্মহীন হওয়া। বাজারের ঊর্ধ্বগতি একদিকে বিশ্ববাসীকে ভাবিয়ে তুলছে, তেমনি উন্নয়নশীল এই বাংলাদেশের মানুষকে কতটা অস্থিরতার মধ্যে রেখেছে তা শুধুমাত্র দেশবাসী জানে। এতসব কিছুর মাঝে যখন মিডিয়ায় দেশের ধর্ষণের পরিসংখ্যান জানে, দেশের মানুষ আজ দিশেহারা।
কোভিড-১৯ সময়টায় বেকার যুবকরা কর্মহীন, লেখাপড়ার অভ্যাস ভুলে যাওয়া, অর্থনৈতিক চাপ বা জীবিকার কঠিন চ্যালেঞ্জ সহ বর্তমান ডিজিটাল ব্যবস্থা বা মোবাইল ফোনে এবং যেভাবে কুসংস্কার, বা কু-দৃশ্যের ছবি যেভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে সেক্ষেত্রে সমাজের সভ্যতা স্বাভাবিক রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। এর মূল কারণ অপ-রাজনীতিদের ক্ষমতার দাপট এবং পেশিশক্তি। যখন রাস্তায় তার অবস্থান দেখায় তখন সমাজের বিবেকবান মানুষ দুশ্চিন্তায় পড়ে যায় এবং নিরব হয়ে সহ্য করে। বাস্তবে তাই ঘটছে এখন। অপরাধ সমাজকে ক্রমেই গিলে খাওয়ার দিকে এগিয়ে চলেছে। স্বার্থান্ধ রাজনীতি তাকে আরও উসকে দিচ্ছে।
সকল ক্ষেত্রেই অপ-রাজনৈতিক ক্ষমতা, শিক্ষা ও জ্ঞানের অভাব এবং ক্ষমতার অবিচল দাপট, আমাদের দেশের ভাবমূর্তি বা সমাজের অবক্ষয় মারাত্মক ভাবে ক্ষুন্ন করছে। প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের এবং সরকারকে এখনি গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে। দেশের উন্নয়নে যে বিষয়গুলোর দেশের জন্য ক্ষতিকর, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া এবং উল্লেখিত বিষয়গুলোর ভাবনা ও গুণিজনের কদর এবং ভালো মানুষের হাতে রাজনীতির নেতৃত্ব দেওয়া এখন সময়ের দাবী।
প্রতিদিনের খবরের কাগজে এমন অনেক খবর আসে, যা দেখলে যে কোনো সভ্য মানুষের হূদয়ে রক্তক্ষরণ শুরু হওয়ার কথা। দেশের মানবাধিকার সংস্থাগুলো বর্তমান বছরের যে ধরণের পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে বা মিডিয়ায় প্রতিদিনের সংবাদে ৪ বছরের শিশু সহ ৭০ বছরের নারী, শিশুদের ধর্ষণের খবর প্রচার হচ্ছে, তাতে বিস্ময় ছাড়া আর কিছুই নয়! এমন এমন ধর্ষণের খবর শুনতে পাই মসজিদের ইমাম, মাওলানা, পুরোহিত, গীজার্র ফাদারসহ নামধারী ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, পুলিশ সদস্য, জনপ্রতিনিধি, শিক্ষক সহ নানা ব্যক্তি নানবিধ অপরাধে গ্রেপ্তার দেখতে পাই, তখন শুধু ভাবি এ-কোন বাংলাদেশ? দেশের স্বাধীনতা অর্জনে পশ্চিমা হানাদার বাহিনী মুক্তিযুদ্ধের সময় দুই লক্ষ মা-বোনদের সম্মান হানি করেছে, তখন ছিল পশ্চিমা হানাদার বাহিনী। ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয় অর্জন করে দীর্ঘ ৫০ বছরে এই স্বাধীন দেশে বর্তমান প্রেক্ষাপটে যেভাবে ধর্ষণের বা বিভিন্ন অপরাধে আমার প্রিয় বাংলাদেশের সম্মান, মযার্দা কতটা ক্ষুন্ন করেছে সে ব্যাপারে বিবেকবান মানুষ দিশেহারা।
শুধু সরকারি দলের বা ছাত্রলীগের নাম গুরুত্ব দিয়ে বলা হচ্ছে সেটা ঠিক নয়। দেশের পরিসংখ্যানে দেখা যায় গত কোভিড-১৯ থেকে যতগুলো ধর্ষণ হয়েছে তার মধ্যে ছাত্রলীগের নাম এসেছে ১৭ বার। কিন্তু ধর্ষকের সংখ্যা প্রায় ১৩ শতর উপরে। পুলিশ, র্যাব, ডিবি ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনী স্বাভাবিক কাজের চেয়ে দেশের এই জঘন্য অপরাধীদের ধর্ষণের ঘটনার উপর এবং অপরাদীদের আইনের কাছে সোপর্দ করে যাচ্ছে। জানা যায়, দেশের কতগুলো উল্লেখযোগ্য ধর্ষণের খবর এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীসহ অন্যের স্ত্রীকে ধর্ষণের ঘটনা তখন গোটা জাতি হতভম্ব। যা কিছু অসভ্য অশ্লীল ঘটনা জাতি হিসেবে দেশের ভাবমূর্তি এবং বিবেকবান মানুষকে নাড়া দিয়েছে। আমাদের এই স্বাধীন সার্বভৌম দেশের সকলেরই লজ্জা হওয়া উচিৎ বলে মনে করি। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে আ’লীগ একটি স্বাধীনতার নেতৃত্ব এবং ঐতিহ্যবাহী দল।
যার প্রধান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যার নেতৃত্বে পেয়েছি আমাদের এই সোনার বাংলাদেশ এবং স্বাধীনতা। অথচ বর্তমানে নাম নেই, শিক্ষা নেই, অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় পারিবারিক পরিচয়ও নেই শুধু ক্ষমতার রাজনীতি করে নিজেকে জাহির করে। বঙ্গবন্ধুর মুজিব কোর্ট আজ অনেক অপরাধীদের আত্মরক্ষার পোষাক হয়ে উঠেছে। কতটা যোগ্যতা যা তাদের দেশপ্রেম এবং মানুষের গ্রহণযোগ্যতা থাকলে মুজিব কোর্ট পড়তে পারবে সেটাও নিধার্রণ হওয়া দরকার। মানুষ আতঙ্কে থাকে ঐ সব সুবিধাভোগী দল বাজদের চারিত্রিক কর্মকান্ড দেখে।
এর সবকিছুরই দায় পরে রাজনৈতিক ভাবে আ’লীগের উপর এবং তার দায় এড়াতে পারে না। দেখা যায় বা আমরা জানতে পাই দলের মধ্যে শুদ্ধি অভিযান চালানোর নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। অথচ, দলের ভিতর আশ্রয় নেওয়া নেতাকর্মীদের বিষয়ে সকল দায়িত্বশীল দলের নেতা ও জনপ্রতিনিধিদের বিষয়টি ভালো ভাবে দেখা প্রয়োজন মনে করি। নইলে এমন একটা সময় আমাদের সকলের সামনে আসবে তখন নেতা কর্মীদের অবস্থান বা ক্ষমতা একটি সময়ে ক্ষীণ হয়ে পড়বে এবং মানুষের কাছে তারা মযার্দা হারাবে। মাও সেতুং এর একটা কথা মনে পরে -যখন বন্ধু বান্ধব সহযোগীদের মধ্যে যখন অপরাধ-অপকর্ম বৃদ্ধি পায়, তখন অপরাধের প্রবণতা বেড়ে যায়।
আমাদের সমাজ ও দেশের সার্বিক অপরাধ ধর্ষণ, খুন, ব্যাভিচার কমাতে হলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মানবিক মূল্যবোধ, শিষ্টাচার, ধর্মীয় অনুভূতি এবং আইন বিষয়ে রাজনৈতিক ও সরকারি ভাবে প্রচার ও সামাজিক আন্দোলন করে প্রকৃত ভালো মানুষ এবং ভালো সমাজ গড়তে হবে। এছাড়া পেশিশক্তির রাজনীতি বন্ধ না করলে সরকারের ভাবমূর্তি ক্রমেই ক্ষুন্ন হয়ে পড়বে।
আমার এই লেখা একজন দেশপ্রেমিক মানুষ এবং সংবাদকর্মী হিসেবে কোভিড-১৯ মোকবেলায় এবং আর্থ সামাজিক উন্নয়ন সহ সরকারের সকল নির্দেশনাগুলো প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি, সুশীল সমাজ সবাইকেই দেশের সম্মানার্থে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসা দরকার। নইলে সমাজের পরিণতি একটি সময় পশ্চিমা হানাদার বাহিনীর চেয়েও আমাদের দেশের সম্মান ক্ষুন্ন হবে।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সভাপতি গলাচিপা উপজেলা প্রেস ক্লাব।