অল দ্য প্রাইম মিনিস্টারস মেন’ তথ্যচিত্র প্রচারের পর বাংলাদেশে যে ধরনের আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে এবং যেভাবে চাপ তৈরির চেষ্টা হচ্ছে, তা নিয়ে আল–জাজিরা উদ্বিগ্ন। তথ্যচিত্রের প্রযোজক উইলিয়াম থোর্ন বিবিসি বাংলাকে এ কথা বলেছেন।

২১ ফেব্রুয়ারি বিবিসি বাংলার অনলাইন সংস্করণে এ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। তথ্যচিত্রের প্রযোজক উইলিয়াম থোর্নের সঙ্গে কথা বলেছেন বিবিসি বাংলার মাসুদ হাসান খান।

উল্লেখ্য, ১ ফেব্রুয়ারি রাতে ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টারস মেন’ নামের তথ্যচিত্র প্রথম প্রচারের পর থেকে এখন পর্যন্ত এটি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, গণমাধ্যম ও রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচনা ও বিতর্ক চলছে।
বিবিসির প্রতিবেদনের প্রথম অংশ: আল–জাজিরা কেন উদ্বিগ্ন

প্রযোজক উইলিয়াম থোর্ন জানিয়েছেন, যাঁদের সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে অনুসন্ধান করা হয়েছে, তাঁদের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া তাঁদের উদ্বিগ্ন করছে। তিনি বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে যারা কন্ট্রিবিউট করেছে তাঁদের বিরুদ্ধে। যে অভিযোগ আনা হয়েছে, তা অবশ্যই গুরুতর। এখানে যেটি গুরুত্বপূর্ণ, সেটি হলো সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা। অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসা সত্যকে চ্যালেঞ্জ করার ক্ষেত্রে এটা (আইনগত পদক্ষেপ) একটি মারাত্মক চেষ্টা।

১৭ ফেব্রুয়ারি প্রতিবেদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট চারজনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে মামলার আবেদন করা হয় ঢাকার একটি আদালতে এবং ২৩ ফেব্রুয়ারি এ আবেদনের ওপর আদালতে শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে।

মামলার আবেদনে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা হলেন ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান, সুইডেনপ্রবাসী সাংবাদিক তাসনিম খলিল, হাঙ্গেরিপ্রবাসী বাংলাদেশি জুলকারনাইন খান সামি এবং আল–জাজিরার ডিরেক্টর জেনারেল ও প্রধান সম্পাদক মোস্তেফা স্যোয়াগ।

উইলিয়াম থোর্ন বলেন, স্বাধীনভাবে কথা বলার অধিকার ছাড়াও যাঁদের কাঁধে বিষয়টি চাপানোর চেষ্টা করা হচ্ছে, তাঁদের পরিবারের বিষয়গুলো নিয়ে উদ্বিগ্ন তাঁরা। তিনি আরও বলেন, ‘অনুসন্ধানে যেসব তথ্য-প্রমাণ হাজির করা হয়েছে, তার বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর জবাব খুঁজে বের করতে না পেরে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাকে খর্ব করা হচ্ছে।’

আল–জাজিরার প্রায় এক ঘণ্টার তথ্যচিত্রে মূলত বাংলাদেশের সেনাবাহিনীপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ এবং তাঁর তিন ভাইয়ের কার্যক্রম দেখানো হয়েছে। জেনারেল আজিজ আহমেদের আপন তিন ভাই ২০০৪ সালে একটি হত্যাকাণ্ডের অপরাধে আদালতে দণ্ডিত হয়েছিলেন।
মামলা থেকে অব্যাহতি ২০১৯ সালে

আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর বা আইএসপিআর ১৫ ফেব্রুয়ারি এক বিবৃতিতে জানায়, আনিস ও হারিছ আহমেদ দুজনই যথাযথ আইনানুগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছিলেন। আর ১৬ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, আনিস ও হারিছকে মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়ে ২০১৯ সালের ২৮ মার্চ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল।

১৬ ফেব্রুয়ারি সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, তিনি যখন তাঁর ভাইদের সঙ্গে দেখা করেন, তার আগেই তাঁদের মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল।

এদিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, আল–জাজিরার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেবেন।

ভাইদের পলাতক বলা হলো কেন

আল–জাজিরার প্রতিবেদন প্রচারের পর আত্মপক্ষ সমর্থন করে জেনারেল আজিজ আহমেদ বলেছেন, তিনি যখন তাঁর ভাইদের সঙ্গে দেখা করেছেন, তার আগেই সরকার তাঁর ভাইদের সব অভিযোগ প্রত্যাহার করে নিয়েছে।

সরকারের পক্ষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানও পরে তা নিশ্চিত করে বলেছেন, যথাযথ আইনগত প্রক্রিয়াতেই তাঁদের সাজা মওকুফ করা হয়েছিল।

তাহলে আল–জাজিরার প্রতিবেদনে তাঁদের পলাতক বলা হলো কেন—এমন প্রশ্নের জবাবে প্রযোজক উইলিয়াম থোর্ন বলেন, ‘আপনি সময়গুলো দেখুন। আপনি দেখুন ২০১৪-১৫ সাল। আমাদের হাতে স্পষ্ট প্রমাণ ছিল যে জেনারেল আজিজ হারিছ আহমেদের জন্য সার্ভিং বিজিবি কর্মকর্তাদের ব্যবহার করে ভুয়া পাসপোর্ট পেতে সহায়তা করেছেন।’

থোর্ন বলেন, ‘পুলিশের ওয়েবসাইটেও তাঁর (আজিজ আহমেদ) ভাই তখন মোস্ট ওয়ান্টেড, যে সময় তাঁদের মামলা থেকে অব্যাহতির কথা বলা হচ্ছে, ঘটনা তারও চার বছর আগের। জেনারেল আজিজ তাঁর ভাইদের ভুয়া পাসপোর্ট পাওয়া ও ইউরোপে যেতে সহায়তা করেছেন। বিশ্বজুড়ে যে সম্পদ তাঁরা করেছেন, কোনোভাবে যেটি সম্ভব হয়েছে, কারণ তাঁদের ভাই বাংলাদেশের সেনাপ্রধান।’
ইসরায়েল নিয়ে বিতর্ক

আল–জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী ইন্টারনেট এবং মোবাইল ফোন নজরদারি করার প্রযুক্তি ইসরায়েল থেকে আমদানি করেছে।

তবে এ অভিযোগ বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সেনাবাহিনী প্রত্যাখ্যান করেছে।

সেনাবাহিনী থেকে জানানো হয়েছে, জাতিসংঘের জন্য নজরদারি যন্ত্রপাতি কেনার বিষয়টি জেনারেল আজিজ আহমেদ সেনাপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব শুরুর আগেই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল।

তাহলে প্রতিবেদনে আজিজ আহমেদের নাম জড়ানো হলো কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে থোর্ন বলেন, ‘হয়তো ক্রয়প্রক্রিয়া আগে শুরু হয়েছে, কিন্তু প্রতিবেদনে আমরা শুধু বলেছি ২০১৮ সালে জেনারেল আজিজ দায়িত্ব নেওয়ার পর চুক্তিপত্রে সই হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘প্রথম কথা হলো জাতিসংঘ মিশনের জন্য এমন বিতর্কিত স্পাইওয়্যার কখনোই ব্যবহার করবে না। বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদেরও তা ব্যবহার করতে দেবে না। শান্তিরক্ষা মিশনে এ ধরনের বিতর্কিত প্রযুক্তির ব্যবহার স্ট্যান্ডার্ড ইস্যু না। এ নিয়ে জাতিসংঘ যেমন প্রশ্ন তুলেছে, আমরাও তুলেছি।’

Leave comment

Your email address will not be published. Required fields are marked with *.