নিজস্ব প্রতিবেদক: ঘরে থাকছেন না করোনা আক্রান্তরা। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে ঘরের বাইরে বের হচ্ছেন তারা। গণপরিবহন ব্যবহার করছেন। রেস্টুরেন্টে খাচ্ছেন, বাজারে কেনাকাটা করছেন। পার্কে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। স্বাস্থ্যবিধির কিছুই মানছেন না তারা। সচেতনতারও বালাই নেই। আইসোলেশন নিশ্চিতেও নেই সংশ্লিষ্টদের নজরদারি।

করোনার সংক্রমণ বাড়ার সময়ে রোগীদের এমন ঘোরাফেরা ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা । পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারকে কঠোর হওয়ার পরামর্শ তাদের। শনিবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিভার ক্লিনিকে করোনার নমুনা পরীক্ষা করাতে এসেছিলেন মিরপুরের আমিনুল। শাহবাগ মোড়ে গণপরিবহন থেকে নেমে করোনা পরীক্ষার লাইনে দাঁড়িয়ে যান তিনি। এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে তিনি জানান, দুই সপ্তাহ আগে প্রথম পরীক্ষা করান তিনি। ফলাফল পজেটিভ আসে। শনিবার এসেছেন ফলোআপ টেস্ট করাতে। করোনা আক্রান্ত অবস্থায় গণপরিবহন ব্যবহার উচিত কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, করোনা নিয়ে বাসে ওঠা যাবে না- এমন কোনো নির্দেশনা তার জানা নেই। আর বাসে ওঠার সময় তো কেউ জানতে চায়নি যে, তিনি করোনা আক্রান্ত কিনা। কিংবা কারও শরীরের তাপমাত্রাও পরীক্ষা করা হয় না। নমুনা পরীক্ষা শেষে গণপরিবহনেই ফিরবেন তিনি।

করোনার স্যাম্পল দেয়া শেষে শাহবাগ মোড়ে চা খাচ্ছিলেন আরেক যুবক। তিনি জানালেন, চিকিৎসক বারবার চা খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে, তাই সেখানে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছেন। এতে স্বাস্থ্যবিধির লঙ্ঘন হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, করোনা টেস্টের ফল পেলে তারপর আইসোলেশনে যাবেন তিনি। একই চিত্র কল্যাণপুর এলাকার একটি বেসরকারি নমুনা পরীক্ষাকেন্দ্রে। নমুনা পরীক্ষা করাতে আসা সন্দেহভাজন করোনা রোগীরা মানছেন না স্বাস্থ্যবিধি। এদের মধ্যে অনেকেই করোনা আক্রান্ত। কেউ এসেছেন দ্বিতীয়বার নমুনা পরীক্ষা করাতে। কেউ কেউ উপসর্গ নিয়ে প্রথমবার পরীক্ষা করাবেন। অধিকাংশ রোগীই এসেছেন গণপরিবহনে। সেখানে কথা হয় সাভারের ব্যবসায়ী আজিজুল হকের সঙ্গে। এক সপ্তাহ ধরে অসুস্থ তিনি। জ্বর ও কাশির উপসর্গ নিয়ে করোনার নমুনা পরীক্ষা করাতে এসেছেন তিনি। এই এক সপ্তাহে বাসার বাইরে বের হয়েছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রতিদিনই দোকানে গেছেন তিনি। দোকানের পণ্য কিনতে ঢাকায়ও এসেছেন দুইবার। রেস্টুরেন্টে খাওয়া-দাওয়া করেছেন। পার্কে বেড়াতে গেছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনার সর্বোচ্চ সংক্রমণ ছিল জুন থেকে আগস্ট মাসের মধ্যে। কিন্তু পরবর্তীতে লকডাউন শিথিল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে করোনা রোগীদের অবাধ বিচরণ শুরু হয়।

আইসোলেশন না মেনে রোগীরা স্বাভাবিক চলাফেরা শুরু করেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সরবরাহ করা তথ্য অনুসারে, ২রা জুলাই দেশে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ছিল সর্বোচ্চ। ওইদিন ৪ হাজার ১৯ জন রোগী শনাক্ত হয়। নমুনা পরীক্ষা হয়েছিল ১৮ হাজার ৩৬২ জনের। আইসোলেশনে যুক্ত হয়েছিলেন ৪৬৯ জন। ছিলেন ১৫ হাজার ৭৫৭ জন করোনা রোগী। পরবর্তীতে অক্টোবরে এসে নমুনা পরীক্ষা কমতে শুরু করে। শনাক্তের সংখ্যা কমে যায়। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হলে আক্রান্তের সংখ্যা আবার বাড়তে শুরু করে। ৩০শে নভেম্বর আক্রান্তের সংখ্যা ছিল প্রায় আড়াই হাজার। ওইদিন আইসোলেশনে যুক্ত হন ২২৯ জন। আর মোট আইসোলেশনে ছিলেন প্রায় ১২ হাজার করোনা রোগী। আক্রান্তের সংখ্যা তুলনামূলক বাড়লেও আইসোলেশনে যুক্তের সংখ্যা বাড়েনি।

করোনার নমুনা পরীক্ষা করাতে আসা রোগীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, অসুস্থতা গুরুতর না হওয়ায় তারা হাসপাতালে ভর্তি হননি। সরকারি হাসপাতালগুলোতে সাধারণত ভর্তি না হলে করোনার নমুনা নেয়া হয় না। সেখানে ফল পেতেও অনেক সময় ৩ থেকে ৪ দিন সময় লেগে যায়। আর প্রাইভেট হাসপাতালগুলোতে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ফল পাওয়া যায়। ভিড়ও কম। তবে প্রাইভেট হাসপাতালগুলোতে পরীক্ষার ফি প্রায় ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা। বাসা থেকে নমুনা সংগ্রহ করালে ফি’র পরিমাণ আরো বেড়ে যায়। খরচ কমাতে তাই পরীক্ষা কেন্দ্রেই নমুনা দিতে আগ্রহী রোগীরা। বাসা থেকে নমুনা সংগ্রহের বিষয়েও তৎপর নয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমআইএস শাখার সহকারী পরিচালক ডা. কামরুল কিবরিয়া জানান, বর্তমানে ১১৮টি প্রতিষ্ঠানের আরটিপিসিআর ল্যাবে করোনার নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে। তবে কতজন রোগী বাসা থেকে নমুনা দিয়েছেন সে সংখ্যা জানাতে পারেননি তিনি।

এ বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মানার দায়িত্ব জনগণের এবং মানানোর দায়িত্ব রাষ্ট্রের। এই দুই কাজে যথেষ্ট শৈথিল্য দেখা যাচ্ছে। যার ফলে সংক্রমণের মাত্রার পাশাপাশি মৃত্যুর হারও বাড়তে পারে বলে আশংকা প্রকাশ করেন তিনি।

প্রসঙ্গত, গত ৮ই মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। আর সাধারণ ছুটি ঘোষণা হয় ২৬শে মার্চ থেকে। তখন থেকেই কার্যত লকডাউন ঘোষণা হয়। কয়েক দফা ছুটিও বাড়ানো হয়। পরবর্তীতে ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে দেশব্যাপী লকডাউন শিথিল করা হয় এবং জোনভিত্তিক কিছু কিছু এলাকাকে লকডাউনের আওতায় আনা হয়। লকডাউন চলাকালীন করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সরকারের তৎপরতা ছিল লক্ষণীয়। করোনা আক্রান্তদের আইসোলেশন নিশ্চিতে ব্যাপক নজরদারি চলে। সাধারণ মানুষকে ঘরে থাকার জন্য উৎসাহিত করা হয়। এমনকি আক্রান্তদের নিকটস্থ থানা থেকে ফোন করে ঘরে থাকার জন্য অনুরোধ করতো পুলিশ। পরবর্তীতে লকডাউন শিথিলের কারণে করোনা রোগীদের ঘরে থাকার প্রবণতাও কমতে থাকে।

Leave comment

Your email address will not be published. Required fields are marked with *.