ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৯৮৮ সাল থেকে প্রতি বছর ১ ডিসেম্বর বিশ্ব এইডস দিবস পালন করে আসছে। এইডস আতঙ্কের নাম। সারা বিশ্বেই আজ এই রোগের ছড়াছড়ি। এক মহামারী দিবসে আরেক মহামারী করোনা ভাইরাস বিশ্বব্যাপী বিদ্যামান। তবে এইডস রোগের খুব কম মানুষই এই সঠিক তথ্য সম্পর্কে অবগত রয়েছেন। সত্যিকার অর্থে রোগটি ভীতিকর হলেও প্রতিরোধযোগ্য। এইচআইভি সংক্রমণের জন্য এইডস মহামারী ছড়িয়ে পড়া বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে এবং যারা এই রোগে মারা গেছে তাদের প্রতি শোক পালন করতে এই দিনটি বেছে নেওয়া হয়েছে। সরকারী ও স্বাস্থ্য আধিকারিকগণ, বেসরকারী সংস্থাগুলি এবং বিশ্বে বিভিন্ন ব্যক্তি, এইডস প্রতিরোধ এবং নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সকলকে সচেতন করতে এই দিনটি পালন করে।

এইডস একটি সংক্রামক রোগ যা এইচআইভি ভাইরাসের সংক্রমণের মাধ্যমে হয়। এটি মানুষের দেহের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাকে দুর্বল করে দেয়। এইচআইভি সংক্রমণের ফলে অন্যান্য রোগ যেমন-নিউমোনিয়া, মেনিনজাইটিস এমনকি ক্যানসারও হতে পারে। এইচআইভি সংক্রমণের পরের ধাপকেই এইডস বলা হয়। জাতিসংঘের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৯৮১ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত ৭ কোটি ৮ লক্ষ মানুষ মরণব্যাধি এইচআইভি-তে আক্রান্ত হয়েছে এবং মারা গেছে ৩ কোটি ৯০ লাখ মানুষ।

এইডস ভাইরাসের উৎপত্তিস্থল: হিউম্যান ইমিউনোডিফিসিয়েন্সি ভাইরাস (এইচআইভি) আবিষ্কারের তিন দশক পরে এসে এর উৎপত্তিস্থল খুঁজে বের করার দাবি করেছেন যুক্তরাজ্যের গবেষকেরা। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা দাবি করেছেন, গত ৩০ বছরেরও বেশি সময়ে সাড়ে সাত কোটি মানুষ আক্রান্ত হওয়ার পর শেষ পর্যন্ত ঠিক কোথা থেকে এইচআইভি ভাইরাস এসেছে, তা শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। গবেষকেরা বলেন, আফ্রিকার বেলজিয়ান কঙ্গোর রাজধানী কিনসাসা থেকে ১৯২০ সালের দিক প্রথম এইচআইভি ছড়ানোর প্রমাণ মিলেছে। হাজারো মানুষের জেনেটিক বিশ্লেষণ করে এই প্রমাণ পাওয়ার দাবি করেছেন তাঁরা। মধ্য আফ্রিকার দেশ বেলজিয়ান কঙ্গো ১৯০৮ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত বেলজিয়ানদের ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে ছিল। এখান থেকে রেলওয়ে নেটওয়ার্ক মাধ্যমে মধ্য আফ্রিকায় এইচআইভি ছড়িয়ে পড়ে বলে গবেষকেরা দাবি করেন।

গবেষকেরা বলছেন, ‘ঔপনিবেশিক একটি শহর থেকে মারাত্মক এইডসের উৎপত্তি হয়। এখনকার কিনসাসা তখন লিওপোল্ডভিল নামে পরিচিত ছিল, পরে মধ্য আফ্রিকার বৃহত্তম শহুরে এলাকা হয়ে দাঁড়ায়। এখানে নিকটস্থ বন থেকে সংগৃহীত বন্য পশুর মাংস বিখ্যাত ছিল। অক্সফোর্ডের গবেষকেরা দাবি করেছেন, এইচআইভি-১ ভাইরাস আবিষ্কারের ৩০ বছর পর মানুষের মধ্যে ব্যাপক আকারের এইচআইভি ছড়িয়ে পড়া, স্থানান্তরিত হওয়ার কারণ অজানাই ছিল। মধ্য আফ্রিকার এইচআইভি-১ সংক্রান্ত তথ্য-পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ১৯২০ সালের দিকে কিনসাসা থেকেই উৎপত্তি হয়েছিল এই ভাইরাসের।

গবেষকেরা আরও বলছেন, নতুন ধরনের পদ্ধতিতে এইচআইভি ভাইরাসের জেনেটিক বিশ্লেষণ করে এই তথ্য জানা সম্ভব হয়েছে। শিম্পাঞ্জি, গোরিলা ও বানর থেকে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার ১৩টি ঘটনা নথিভুক্ত রয়েছে। কিন্তু এইচাইভি-১ এর এম গ্রুপটিই মানুষের মধ্যে বেশি ছড়ানোর প্রমাণ পাওয়া যায়। এইচআইভি-১ ভাইরাসের গ্রুপ ‘এম’ এবং আরেকটি গ্রুপ ‘ও’। ১৯৬০ সাল পর্যন্ত একই হারে বাড়লেও পরে এম গ্রুপটি তিন গুণ হারে বেড়েছে। এর কারণ হতে পারে সুচের একাধিকবার ব্যবহার ও যৌনকর্মীদের কাছে যাওয়ার হার বেড়ে যাওয়া।

গবেষক অলিভার পাইবাস বলেন, ‘আমরা প্রথমবারের মতো সব সহজলভ্য প্রমাণ ফাইলোজিওগ্রাফিক পদ্ধতিতে বিশ্লেষণ করি। এতে ভাইরাসটি কোথা থেকে এসেছে তা পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে ধারণা করা সম্ভব হয়। এর অর্থ ভাইরাসের উৎপত্তির বিষয়টি নিশ্চিত করেই বলা সম্ভব। গবেষক নুনো ফারিয়া বলেন, কিনসাসা ওই সময় দ্রুত এগিয়ে চলছিল। মধ্য আফ্রিকার বৃহত্তম শহর হিসেবে পুরো কঙ্গোর সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। ঔপনিবেশিক আমলের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ১৯৪০ সালের শেষ নাগাদ প্রতিবছর রেলে ১০ লাখেরও বেশি মানুষ কিনসাসায় যেতেন। জেনেটিক তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, কঙ্গোতে দ্রুত এইচআইভি ছড়িয়ে পড়ে।

এইডস এর লক্ষণ: জ্বর, মাথা ব্যাথা, ফুসকুড়ি, পেশী বা যৌথ ব্যথা, গলাব্যথা , ফুসকুড়ি গ্রন্থি গ্রন্থি, অবসাদ, অতিসার, ওজন কমানো, ছত্রাক সংক্রমণ এরকম হতে পারে, দ্রুতগতিতে ওজন কমে যাওয়া। শুষ্ক কাশি, বার বার জ্বর আসা। রাতের বেলায় প্রচন্ড ঘামিয়ে যাওয়া। অনবরত এবং বর্ণনাতীত দুর্বলতা। কিছু স্থানের লসিকাগ্রন্থি ফুলে যাওয়া। এক সপ্তাহের বেশি সময় ডায়রিয়া। এর ব্যতিক্রমধর্মী কোনো দাগ জিহ্বা বা মুখের ভিতর দেখা। স্মৃতিশক্তি ধীরে ধীরে নষ্ট হওয়া ও বিষন্নতা। যে এইচআইভি ও এইডস রোগের শারীরিক লক্ষণ দেখা না দিলেও তা রোগীর দেহে বিদ্যমান থাকতে পারে।

প্রতিরোধে করণীয়: এইচআইভির প্রতিরোধের মূল উপাদান হলো শিক্ষা, সচেতনতা, ঝুঁকির মাত্রা সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান ও ধারণা। মানুষের চিন্তায় ও আচরণের ইতিবাচক পরিবর্তন অত্যন্ত জরুরি। ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা এইডস প্রতিরোধের অন্যতম উপায়। যৌন সম্পর্কের ক্ষেত্রে ধর্মীয় ও সামাজিক অনুশাসন মেনে চলতে হবে। বিবাহপূর্ব যৌন সম্পর্ক এড়িয়ে চলতে হবে। একাধিক যৌন সঙ্গী পরিহার করতে হবে। নিরাপদ যৌনক্রিয়ার অভ্যাসের মাধ্যমে অসংক্রামিত মানুষ এইচআইভি সংক্রমণ থেকে মুক্ত থাকতে পারে। নিয়মিত ও সঠিকভাবে কনডম ছাড়া যৌন মিলন থেকে বিরত থাকতে হবে। অবাধ ও অবৈধ যৌন ক্রিয়া থেকে বিরত থাকাই হলো এইচআইভি সংক্রমণ থেকে মুক্ত থাকার সর্বোৎকৃষ্ট উপায়।

যারা শরীরে ইনজেকশনের মাধ্যমে ড্রাগ নেয়, তাদের বেলায় উৎকৃষ্ট উপায় হলো ইনজেকশনের মাধ্যমে ড্রাগ না নেওয়া। যদি তা সম্ভব না হয়, তবে এইচআইভি সংক্রমিত রোগীর সঙ্গে পুনরায় ব্যবহারযোগ্য সুচ, সিরিঞ্জ, ব্লেড বা অন্যান্য যন্ত্রপাতি ব্যবহার পরিহার করতে হবে। একবার ব্যবহার করা এমন জীবাণুমুক্ত সুচ ও সিরিঞ্জ ব্যবহার করতে হবে। শরীরে রক্ত বা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গ্রহণের প্রয়োজন হলে পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে হবে যে সে রক্ত বা অঙ্গ- প্রত্যঙ্গে এইচআইভি রয়েছে কি না।

যৌনরোগ বা প্রজননতন্ত্রের সংক্রমণ থাকলে এইচআইভি আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। তাই কারো যৌনরোগ বা প্রজননতন্ত্রের সংক্রমণ থাকলে দ্রুত চিকিৎসা করাতে হবে। এইচআইভি আক্রান্ত মায়ের থেকে সন্তানের আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা অনেকখানি। তবে যেসব মায়েরা প্রয়োজনীয় থেরাপি গ্রহণ করেন, তাদের ক্ষেত্রে গর্ভস্থ সন্তান আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা শতকরা ৮৫ ভাগ। জনসচেতনতা বাড়াতে বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমের সাহায্যে প্রতিরোধমূলক তথ্য জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে হবে।

হোমিও সমাধান: রোগ নয় রোগীকে চিকিৎসা করা হয়। আমরা জানি, এইচআইভি সংক্রমণ ঘটে থাকে রক্ত, বীর্য, ভেজাইনাল বা সার্ভিক্যাল স্রাব এবং মায়ের দুধের মাধ্যমে। প্রাথমিক পর্যায়ে এর লক্ষণ প্রকাশ নাও হতে পারে। তবে একিউট রেট্রোভাইরাল সিনড্রম দেখা দিতে পারে। কিনিক্যাল স্টেজ-১, এতেও লক্ষণ তেমন প্রকাশ পায় না; কিন্তু লসিকাগ্রন্থি অনেক দিন ধরে ফুলা থাকতে পারে, বিশেষভাবে ইঙ্গুইনাল লসিকাগ্রন্থি। কিনিক্যাল স্টেজ-২, এতে ওজন হ্রাস পেতে থাকে। বারবার সাইনোসাইটিস, টনসিলাইটিস, ওটাইটিস মিডিয়া ও ফ্যারিনজাইটিস হতে পারে। এ পর্যায়ে হার্পস জোস্টার, মুখে ঘা ও নখে ফাংগাল ইনফেকশন হতে পারে। কিনিক্যাল স্টেজ-৩, এতে ওজন হ্রাস অব্যাহত থাকে। এক মাসের বেশি ডায়রিয়া থাকতে পারে। নিয়মিত জ্বর থাকতে পারে। মুখে ঘা অব্যাহত থাকে। ফুসফুসে যক্ষ্মা দেখা দিতে পারে। অথবা নিউমোনিয়া, এমপায়েমা ও জোড়ায় জোড়ায় ব্যথা হতে পারে। এ সময় রক্তশূন্যতা ও নিউট্রোপেনিয়ার লক্ষণও দেখা যায়। কিনিক্যাল স্টেজ-৪, এতে নিউমোসিস্টাইটিস নিউমোনিয়া কিংবা বারবার ব্যাকটেরিয়াল নিউমোনিয়া দেখা দিতে পারে। এছাড়া লিম্পোমা, ক্যাপোসিস সারকোমা, ইনভেসিভ সার্ভিক্যাল কার্সিনোমাও এ পর্যায়ে হতে পারে। ক্রনিক ডায়রিয়া এ ধরনের রোগীদের নিত্যসঙ্গী। এসব বর্ণিত লক্ষণাগুলো বয়স্ক রোগীদের জন্য প্রযোজ্য। আরো অনেক লক্ষণ এ ধরনের রোগীদের মধ্যে পাওয়া যায়।

১৯৮৯ সাল থেকে ভারত সরকার পরিচালিত ক্লিনিক্যাল গবেষণায় দেখা গেছে, এইচআইভি বা এইডস রোগীদের জন্য হোমিওপ্যাথি ওষুধ কার্যকর। ভারত সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন সেন্ট্রাল কাউন্সিল ফর রিসার্চ ইন হোমিওপ্যাথি কর্তৃক প্রকাশিত গবেষণাগ্রন্থ এইচআইভি এইডস এবং হোমিওপ্যাথিক ম্যানেজমেন্ট, সারা বিশ্বের জন্য একটি আশার আলো। ২২টি হোমিওপ্যাথিক ওষুধের কিনিক্যাল স্টাডি স্থান পেয়েছে ওই গবেষণা গ্রন্থে। আমরা আশা করি, আমাদের সরকার এ ধরনের গবেষণাগ্রন্থ থেকে দিকনির্দেশনা নিয়ে বাংলাদেশের এইচআইভি বা এইডস রোগীদের জন্য হোমিওপ্যাথি ওষুধের দরজা খুলে দেবে, যাতে করে রোগীরা হোমিওপ্যাথি ওষুধের কার্যকর ফলাফল লাভ করতে পারেন। এইডসে আক্রান্ত হওয়া থেকে বাঁচতে মানুষকে আরও বেশি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

লেখক: সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক স্বাস্থ্য তথ্য
স্বাস্থ্য বিষয়ক উপদেষ্টা, হিউম্যান রাইটস রিভিউ সোসাইটি কেন্দ্রীয় কমিটি
কো-চেয়ারম্যান, হোমিওবিজ্ঞান গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র
মোবা.০১৮২২৮৬৯৩৮৯

Leave comment

Your email address will not be published. Required fields are marked with *.